সম্প্রতি দু’জন বিনিয়োগকারীর ক্রীত শেয়ারগুলোর বা পোর্টফোলিওর ফর্দ আমার হাতে এসেছে। এ দু’জনের মধ্যে একজন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি অনেক দিন বিদেশে চাকরি করে সে টাকার বড় একটা অংশ শেয়ারবাজারে খাটিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আজকের মূল্যে উনি উনার নিজের পুঁজিই এক-তৃতীয়াংশ হারিয়েছেন। উনি যেটা মারাত্মক ভুল করেছেন সেটা হলো, ব্রোকার হাউসের কথা শুনে আরও সমপরিমাণ অর্থ শুধু কতগুলো ব্যাংকিং কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন, যেগুলোর মূল্য ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পড়ে গেছে। উনাকে বলালাম, আপনি ঋণটা শোধ করে দিলেন না কেন, এমনকি পড়তি বাজারেও। উনি বললেন, উনি তাই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্রোকার হাউসের লোকজন তা করতে দেয়নি। উল্টো উনাকে পরামর্শ দিয়েছে, লোকসান দিয়ে ঋণ শোধ করবেন কেন বরং কিছু টাকা নতুন করে বিনিয়োগ করুন। পড়তি মূল্যে আপনাকে অধিক শেয়ার কিনে লোকসানটাকে পুষিয়ে দেয়া যাবে। এ কথা শুনে অধ্যাপক কবির আরও ২০ লাখ টাকা তার বিও হিসাবে জমা করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আগে কবির সাহেবের লোকসান হয়েছিল ২৫ লাখ টাকা আর নতুন অর্থ জমা দেয়ার দুই মাস পর তিনি পুঁজি হারিয়েছেন ৩৫ লাখ টাকা। তাহলে তার এ টাকা ক্ষয় হলো কীভাবে?
ক্ষয় হয়েছে ঋণের সুদে এবং বাকিটা হয়েছে বাজার আরও পড়ে যাওয়ার কারণে। আমি কবির সাহেবকে দুটো কথা বললাম। এক, পড়তি বাজারে অতিরিক্ত ঋণ করে শেয়ার কিনে পোষানো যায় না। ব্রোকার হলো ঋণ বিক্রেতা, সে তো চাইবেই চড়া সুদে আরও বেশি ঋণ করা। দুই, উচিত ছিল বাজার পড়ার সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋণগুলো শোধ করে দেয়া। তাতে লোকসান হতো ন্যূনতম। এ কথা শুনে অধ্যাপক বললেন, আসলে এসব কথা উনাকে আগে কেউ বলেননি এবং উনি নিজে শেয়ারের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতেনও না। উনার বন্ধুরাই উনাকে শেয়ারবাজারের দিকে নিয়েছেন ২০১০-এর জুন মাসে। অন্য বিষয় হলো, উনার পোর্টফোলিওতে সবই ব্যাংকিং কোম্পানরি শেয়ার, যেগুলো অন্য শেয়ারের তুলনায় অতিরিক্ত মূল্য হারিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সবই ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার কেন? উনি বললেন, কোন শেয়ার কিনব বা বেচব সে ব্যাপারে তার মতামত ছিল না। ব্রোকার হাউসের সুমন তাকে ওইসব শেয়ার কিনে দিয়েছে। আসলে এই অধ্যাপক সাহেব যেটা বড় ভুল করেছেন সেটা হলো, ব্রোকার হাউসের লোকজনের কথা অনুযায়ী শেয়ার কেনা। আমি উনাকে বললাম, ব্রোকার হাউসে যারা চাকরি করে তারা এ ক্ষেত্রে কোনো এক্সপার্ট না। তাদের তুলনা করতে পারেন ওষুধের দোকানের ইমনের সঙ্গে, যে অভিজ্ঞতা থেকে ব্যথার ওষুধ থেকে গ্যাস্টিক, পাতলা পায়খানা, এমনকি ডায়াবেটিসের ওষুধও বিনা প্রেসক্রিপশনে বিক্রি করছে। কিন্তু তাই বলে কি ইমন ডাক্তার হয়ে গেল? এ জন্যই বলছি, ব্রোকার হাউসের ব্রোকার বা তার নিয়োজিত অন্য ছেলেগুলো শেয়ার সিলেকশন এবং বেচার ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়ার মতো মোটেই উপযুক্ত লোক নয়। তারা এই লক্ষ্যে কোনো লেখাপড়া করেনি বা এ জন্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত কোনো লোকও নয়। তাদের কথা ফলে যখন বাজার শুধু উঠতেই থাকে। কিন্তু বাজার পড়ে গেলে বা এক স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কী করতে হবে সে ব্যাপারে তাদের সামান্যই জ্ঞান আছে। আর তারা যদি অত বড় এক্সপার্ট হতো তাহলে ব্রোকার হাউসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার চাকরি করছে কেন? অধ্যাপক সাহেবকে আমি এত বললাম, এ ক্ষেত্রে হয়তো সুমনের দোষ নেই। সে যেটা বিশ্বাস করেছে সেটাই আপনাকে বলেছে। তবে সমস্যা ছিল, তার বিশ্বাসের মধ্যে ভুল ছিল। আমি উনাকে আরও দুটো কথা বললাম। সেই দুটো কথা হলো— এক, শেয়ার সম্পর্কে নিজের কিছু জ্ঞান থাকতে হবে। সে জ্ঞানের জন্য কিছু বই এবং লিটারেচার পড়তে হবে। কিছু না পড়ে সুমনদের মতো লোকদের কথা শুনে যারা শেয়ার কিনেছে তারাই বেশি লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। উনাকে এত বললাম, আমার নিজেরও একটা বই বাজারে আছে— নাম ‘জেতার কৌশল’। ওই বইয়ের কয়েকটি পৃষ্ঠায় আমি এও লিখেছি, ‘ব্রোকারকে জিজ্ঞেস করে শেয়ার কিনবেন না’। আপনি যদি ওই বইটিও পড়তেন তাহলে অন্তত কিছু টাকা হারানো থেকে বেঁচে যেতেন। আমি ওই বইতে এও লিখেছি, ঋণ বিক্রেতার অভাব নেই। তবে ঋণ করে শেয়ার কিনতে সাবধান। দুই, কবির সাহেবকে এও বললাম শেয়ার ধরন বা কেনার জন্য সিদ্ধান্তের জন্য অনেক কিছু জানতে হয় এবং সেই জানা শুধু এক সময়ের জানা হলে চলবে না, সব সময় জানতে হয়। লোকে মাঝ বয়সী ভালো ডাক্তারের পেছনে কেন দৌড়ায়। কারণ তাদের বিশ্বাস, এরা ওষুধ ও রোগের সর্বশেষ গবেষণা ও লিটারেচার সম্পর্কে অবহিত। যদিও কোনো কোনো ডাক্তার ওইগুলোর ধারে কাছেও নেই। অভিজ্ঞ বুড়ো ডাক্তার ভালো বটে, তবে ওষুধ ও রোগের ক্ষেত্রে সর্বশেষ অবস্থাগুলো উনি জানেন না। যাহোক, ওষুধ ও রোগের জগতে যেমন ভালো ডাক্তারের অভাব রয়েছে, তেমনি শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে প্রকৃত জ্ঞানধারী লোকের অভাব আছে। এই বিষয়টা যদি এতই সহজ হতো তাহলে তো বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফিন্যান্স ও পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপকরা যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক বাজার ওয়ালস্ট্রিটে শেয়ার বেচাকেনা করে বিলিয়নিয়ারও হয়ে যেতেন। সত্য হলো— এসব ক্ষেত্রে পড়ানো যত সহজ, বাস্তব ক্ষেত্রে অর্থ খাটিয়ে অর্থ রোজগার করা অত সহজ নয়। তবে হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে ভালো করার জন্য অত বড় ডিগ্রির দরকার নেই বটে। পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতা অনেককে এক্সপার্ট হতে সাহায্য করে। আমার বইতে আমি এও লিখেছি, পরামর্শের ক্ষেত্রে আপনার বন্ধুই আপনার জন্য ভালো পরামর্শক। শর্ত থাকে, আপনার বন্ধুকে আপনার মতো বা আপনার থেকে বেশি জানতে হবে। মেডিসিন ডাক্তারের অসুখ হলে উনি আরেক মেডিসিন ডাক্তারের পরামর্শ কেন নিচ্ছেন? এটা এ জন্যই যে, উনার জ্ঞানের সঙ্গে অন্য মেডিসিন অধ্যাপকের জ্ঞানকে ঝালাই করে নিচ্ছেন। রোগী ভীষণ অসুস্থ হলে মেডিকেল বোর্ড বসে কেন? এ জন্যই যে, একজনের জ্ঞান থেকে পাঁচজনের জ্ঞান বেশি ভালো হবে। শেয়ার কেনার এবং বেচার ক্ষেত্রেও পাঁচজনের জ্ঞান একজনের জ্ঞান অপেক্ষা উত্তম। শর্ত থাকে যে, ওই পাঁচজনের ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। অনভিজ্ঞ-মূর্খ লোকদের সঙ্গে এসব ব্যাপারে আলাপ করে কোনো লাভ নেই। সমস্যা হলো, আমাদের বাজারে ৮০ শতাংশ লোক সুমনদের কথায় শেয়ার কেনে আর বেচে। এদের জন্য শেয়ারবাজারে নয়। এরা বাজারে যখন নতুন অর্থ নিয়ে প্রবেশ করেছে, তখন শেয়ারের মূল্য বেড়েছে। এখন হেরে অনেকটা বাজার ছাড়া। ব্রোকার হাউসের লোকজন বড়জোর ভোক্তাদের মধ্যে জিপির কাজ করতে পারবে। তারা কোনো দিন এমআরসিপির কাজ করতে পারবে না। সুতরাং শেয়ারবাজারে লাভ যেমন বেশি, তেমনি লোকসানও বেশি। আপনাদের ওষুধের লোকরাই তো আমাকে বলেছে, কোনো ওষুধের সাইড এফেক্ট দেখা দিলে হয় ওষুধ বন্ধ করতেন নতুবা তাড়াতাড়ি ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। এ ক্ষেত্রেও তাই ভুল হয়ে গেছে মনে করলে তাড়াতাড়ি শুদ্ধ করতেন। লোকসান দিয়ে বেচুন। অপেক্ষা করুন। সুযোগ এলে ওই শেয়ারে বা নতুন কোনো শেয়ারে বেচুন। এসবই সংক্ষিপ্ত আকারে আমি আমার বইটার মধ্যে লিখেছি। সমস্যা হলো, আপনারা কেউ বই পড়তে চান না। আর্থিক বিবরণীগুলোকে ব্যাখ্যা করা বা বোঝা অত সহজ নয়। অথচ শেয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ বিদ্যা অবশ্যম্ভাবী। আমাদের বাজারে কয়টা লোক আছেন, যারা আর্থিক বিবরণী পড়েন এবং জানেন। যাক আপনাকে আমি স্বল্প সময়ে এক্সপার্ট বানাতে পারব না। কথা হলো, অতীতে যে ভুলগুলো করেছেন তা যাতে ভবিষ্যতে না করেন। আর সুমন-ইমনের কথা শুনবেন না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে দেবেন। অধ্যাপক কবির ওষুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অধ্যাপক। সে জন্য উনাকে বোঝাতে ডাক্তারদের উদাহরণ দিলাম। উনি শেষে আফসোস করে বললেন, ইস আগে যদি আপনার সঙ্গে আলাপ করতাম। আমি বললাম, করেননি কেন? উনি বললেন, এক তো সাহস হয়নি, অন্য বিষয় ছিল ২০১০-এর নভেম্বর পর্যন্ত সবই ঠিক গেল মনে হলো। কবির সাহেবের সঙ্গে ৪৫ মিনিট আলাপ হলো। আশার মতামত দিয়ে উনাকে ছেড়ে দিলাম। দ্বিতীয়, বিনিয়োগকারী ছিলেন একজন অবসারপ্রাপ্ত সচিব। উনিও অনেক টাকা হারিয়েছেন। প্রায় একই শেয়ার ও একই ধরনের ভুল উনিও করেছেন। উনাদের দু’জনেরই ব্রোকার ছিল একটা ব্যাংক। লেখক: অর্থনীতিবিদ
Source : http://www.bonikbarta.com
No comments:
Post a Comment