Friday, September 23, 2011

পরিচালকদের শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা এসইসির

শেয়ারবাজারে চলমান দরপতন ঠেকাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। ১৯৬৯-এর ২০ (এ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক অথবা পাঁচ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি শেয়ারধারণকারী শেয়ারহোল্ডাররা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত শেয়ার বিক্রি করতে পারবেন না।
 গতকাল বুধবার এসইসিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান এসব তথ্য জানান।
 বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শেয়ারবাজারে ২০০৯ সাল থেকে বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি এবং সে সময়ে শেয়ারের প্রচণ্ড সংকটের কারণে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দর। হঠাত্ করেই শেয়ারের দর বৃদ্ধির সুযোগে বেশির ভাগ কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন। ডিএসইর ওয়েবসাইটে উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা গত দুই বছরে যে পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন তার বাজারদর হিসাব করলে দেখা যাবে, ওই সময়ে তারা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন।
 এই বিক্রির চাপ বাজার পতনের একটি বড় কারণ বলে মনে করছে বাজার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার পরও দরপতন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে গতকাল বুধবার তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এসইসি। গত সপ্তাহে শেয়ারবাজারের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকের পর এসইসি গতকাল এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়। পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকবে বলে জানিয়েছেন এসইসির মুখপাত্র সাইফুর রহমান।
 তবে এসইসির এ সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেছেন এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তের কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। এসব সিদ্ধান্ত অ্যাডহক ভিত্তিতে নেয়া হচ্ছে। কমিশন সম্ভবত এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সূচক বাড়াতে এবং সেল প্রেসার কমাতে। তবে এত কিছুর পরও বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আস্থা দেখাচ্ছে না। আমি মনে করি, এসইসির উচিত সব ধরনের বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলা। কেন তারা বাজারের প্রতি এত উদাসীন আচরণ করছেন সেটা বের করে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, মূল শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বোনাস শেয়ারেও নিষেধাজ্ঞা থাকা উচিত। শেয়ার তো শেয়ারই। সুতরাং মূল শেয়ার বিক্রিতে লক ইন থাকলে বোনাস শেয়ারেও লক ইন থাকা উচিত।’
 অন্যদিকে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের সভাপতি সালমান এফ রহমান জানিয়েছেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে নিজেদের কোম্পানির শেয়ার কিনতে ইচ্ছুক। এ জন্য তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে গতকাল এসইসির সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তবে শেয়ার ক্রয়ের জন্য এ-সংক্রান্ত সিকিউরিটিজ আইনের কিছু সমস্যা রয়েছে। এগুলো সমাধানের জন্য এসইসির সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। এসইসি আশ্বাস দিয়েছে।
 প্রসঙ্গত, বর্তমানের সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা স্টক এক্সচেঞ্জে ঘোষণার মাধ্যমে নিজেদের কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করতে পারেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনসাপেক্ষে স্টক এক্সচেঞ্জে ঘোষণার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে নিজেদের কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করতে পারেন।
 তবে চাইলেই বছরের যেকোনো সময়ে উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা নিজেদের কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করতে পারেন না। ২০১০ সালের ২৩ মার্চ তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালকদের শেয়ার কেনাবেচায় বিধি-নিষেধ আরোপ করে এসইসি। এ জন্য সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অর্ডিন্যান্স (সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ) ১৯৯৫-এ সংশোধনী আনা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কোন স্পন্সর, পরিচালক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী, নিরীক্ষক বা নিরীক্ষাকার্যে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, পরামর্শক বা আইন উপদেষ্টা কিংবা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কোন সুবিধাভোগী, উক্ত কোম্পানির বার্ষিক হিসাব সমাপ্তির তারিখের দুই মাস পূর্ব হইতে উক্ত হিসাব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক চূড়ান্তভাবে বিবেচিত, গৃহীত বা অনুমোদিত হওয়ার তারিখ পর্যন্ত সময়কালে আলোচ্য কোম্পানির শেয়ার ক্রয়, বিক্রয় বা অন্য কোন প্রকারে হস্তান্তর বা গ্রহণ করতে পারবেন না।’
 জানা গেছে, ওই আইনের কারণেই কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা চাইলেই যে কোনো সময় শেয়ার কেনাবেচা করতে পারেন না। বাজারের বর্তমান মন্দাবস্থা বিবেচনায় কিছুদিনের জন্য আইনটি স্থগিত অথবা নতুন কোনো নির্দেশনা চেয়েছেন শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংগঠন। তবে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি সালমান এফ রহমান। গতকাল ডিএসইতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংগঠন বাজারের বর্তমান নেতিবাচক পরিস্থিতিতে সাপোর্ট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য সংশ্লিস্ট কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে নিজেদের কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করবেন। তবে এ জন্য কিছু আইনি সমস্যা রয়েছে। সমস্যাটি নিয়ে এসইসির সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে বলে তিনি জানান। আইনটি সংশোধন হলেই উদ্যোক্তাদের শেয়ার কেনার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
 এ বিষয়ে ঢাকা ষ্টক একচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আশা করি এসইসির এই সিদ্ধান্তে আপাতত সেল প্রেসার কমবে। বাজারের এ অবস্থার মধ্যে লাখ লাখ শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব ঠেকাতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমার ধারণা, বাজার আবার স্বাভাবিক হলে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে কমিশন।’
 তিনি জানান, এসইসি মূলত তার আইন কানুন পর্যালোচনা করছে। পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এই আইনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছে। লক ইন বা বোনাস শেয়ার বিক্রির বিষয়ে কমিশন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। শাকিল রিজভী বলেন, ‘বাজারের বর্তমান অবস্থার আসলেই কোনো ব্যাখ্যা নেই। এটা আমাদের বাজারের ক্ষেত্রে বাড়া বা কমার ব্যাখ্যা অনেক সময় পাওয়া যায়নি। কিন্তু অন্য সব কিছুর মতো শেয়ারবাজারেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আমি আপনাদের বলি বাজার ঘুরবেই, দাম ও সূচক পড়লেও সব কিছু শূন্য হয়ে যাবে না।’
 প্রসঙ্গত, গত দুই বছরে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালক ও উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারে নিজেদের হাতে থাকা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। শেয়ারবাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯ সালের মে থেকে শুরু করে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত বিভিন্ন খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলো। এর পরপরই রয়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, টেক্সটাইল, প্রকৌশল, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতের কোম্পানি।
 ২০০৯ সালের মে থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি শেয়ার বিক্রি করেছেন। একই সময়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা বিক্রি করেছেন প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার শেয়ার। এ ছাড়া বস্ত্র খাতের পরিচালকরা ২ হাজার কোটি টাকা, প্রকৌশল খাতের পরিচালকরা ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা, জ্বালানি খাতে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, বীমা খাতের প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, ওষুধ ও রসায়ন খাতে ৬৫০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। এ ছাড়া খাদ্য, আইটিসহ অন্যান্য খাতের কোম্পানির পরিচালকরা বিপুল পরিমাণের শেয়ার বিক্রি করেছেন।
 এদিকে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর উদ্যোক্তা অংশের পরিমাণ খুবই কম। অথচ এসব কোম্পানির উদ্যোক্তারা নিয়মিত শেয়ার বিক্রি করছেন। এ বিষয়ে সাইফুর রহমান বলেন, ‘ইদানীং কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তারা যাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার হাতে রাখেন, সে ব্যাপারে বলা হবে। এ জন্য উদ্যোক্তাদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়ার বিষয়টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে ন্যূনতম কী পরিমাণ শেয়ার উদ্যোক্তাদের ধারণ করতে হবে তা এখনো ঠিক হয়নি।

6 comments: